শেষ বলে জয় তুলে নিল KKR বাহিনী , পয়েন্ট তালিকায় অনেকটা ভাল অবস্থায় চলে গেল তারা ।
রবিবারের পর আন্দ্রে রাসেল কি কেকেআর জনতার মনে নিজের জায়গাটা আরও মজবুত করে নিলেন?
প্রশ্ন উঠতেই পারে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে টানা দু’বার দুশোর বেশি রান তুলে হারের উপক্রম তৈরি হয়েছিল। ম্যাচ প্রায় কেড়ে নিয়েছিলেন উইল জ্যাকস এবং রজত পাটীদার। রাসেল নিজের প্রথম ওভারে দু’জনকে ফিরিয়ে দিলেন। শেষ দিকে এসে আইপিএলের অন্যতম সেরা ফিনিশার দীনেশ কার্তিককেও ফেরালেন। তবু শেষ ওভারে কোহলিদের জেতানোর ‘দায়িত্ব’ নিয়ে নিয়েছিলেন মিচেল স্টার্ক। তবে ১ রানে টান টান ম্যাচে জিতে শেষ হাসি কলকাতারই।
টসে হেরে ঘরের মাঠে আগে ব্যাট করতে নেমেছিল কলকাতা। সুনীল নারাইনের অফ ফর্ম থাকা সত্ত্বেও প্রথমে ফিল সল্ট এবং পরে শ্রেয়স আয়ারের অর্ধশতরানের সৌজন্যে আগে ব্যাট করে ২২২/৬ তোলে কলকাতা। জবাবে বিরাট কোহলি এবং ফ্যাফ ডুপ্লেসি ব্যর্থ হলেও জ্যাকস এবং পাটীদার বেঙ্গালুরুকে প্রায় জিতিয়ে দিয়েছিলেন। রাসেল তাঁদের ফেরানোর পর শেষ ওভারে স্টার্ককে তিনটি ছয় মারেন কর্ণ শর্মা। তিনি আউট হওয়ার পর শেষ বলে ২ রান দরকার ছিল। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে আউট হন লকি ফার্গুসন।
ম্যাচের পর অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে একটা প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি ওঠা উচিত, আর কত দিন কেকেআর বয়ে বেড়াবে স্টার্ককে? এ দিন প্রথম ২ ওভারে ৩৬ রান দিয়ে এমনিতেই কেকেআরের কাজ কঠিন করে দিয়েছিলেন। পরের দিকে বাকি বোলারেরা মিলে তা সামাল দিলেও শেষ ওভার সেই তাঁকেই দেওয়া হয়। তখনও জিততে চাই ২১ রান। বিপক্ষে কর্ণ শর্মার মতো অখ্যাত ক্রিকেটার। তাঁর হাতে পর্যন্ত তিনটি ছয় খেলেন স্টার্ক! সেই বোলারের দাম কখনও ২৫ কোটি হতে পারে? এর পরেও হয়তো স্টার্ককে সামলাতে আসরে নামবেন গৌতম গম্ভীর, শ্রেয়স আয়ারেরা। কিন্তু শাক দিয়ে যে মাছ ঢাকা যায় না তা সমর্থকেরা বুঝে গিয়েছেন। আর কোনও ভাবেই স্টার্কের ব্যর্থতা লুকনো যাবে না।
কেকেআরের ইনিংসের প্রথম ওভার দেখেই বোঝা গিয়েছিল এই পিচে বল সহজে ব্যাটে আসবে না। তবু মহম্মদ সিরাজকে ছয় এবং চার মেরে শুরুটা খারাপ করেননি ফিল সল্ট। দ্বিতীয় ওভারে যশ দয়ালকে দু’টি চার মারেন। কিন্তু উল্টো দিকে সুনীল নারাইন একেবারেই খেলতে পারছিলেন না। এক সময় প্রথম সাত বলে কোনও রান করতে পারেননি। তৃতীয় ওভারে সিরাজ বেশ বেকায়দায় ফেলেন তাঁকে। পাওয়ার প্লে-র সুযোগ কাজে লাগাতে পারছিল না কেকেআর।
চাপ অনেকটাই কাটে চতুর্থ ওভারে। লকি ফার্গুসনকে চারটি চার এবং দু’টি ছয় মেরে ২৮ রান নিয়ে রান রেট অনেকটাই বাড়িয়ে দেন সল্ট। তবে পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলেই তাঁকে তুলে নেন সিরাজ। কিছু ক্ষণ পরে ফেরেন নারাইনও। রান করতে না পেরে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলেন। বড় শট খেলার প্রচেষ্টায় আউট হন। যশ দয়ালের বল অনেকটা দূরে থাকলেও শরীর একটুও না এগিয়ে শট মারেন। স্লোয়ার বলে বড় শট খেলা সহজ ছিল না। পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে নারাইনকে ফেরান দয়াল।
পাওয়ার প্লে-র মধ্যে ফিরে যান অঙ্গকৃশ রঘুবংশীও। দয়ালের একই ওভারে মিড-অনের উপর দিয়ে হালকা শট খেলতে গিয়ে উইকেট দিলেন। কেকেআরের ব্যাটারদের দরকার ছিল এই সময় ধস সামাল দেওয়ার। সেটার দিকেই মন দিলেন শ্রেয়স এবং বেঙ্কটেশ আয়ার। হাতে উইকেট থাকায় পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পর অহেতুক তাড়াহুড়ো করলেন না। বল ধরে খেলছিলেন। অফ ফর্মে থাকা বেঙ্কটেশের কাছে সুযোগ ছিল এই ম্যাচে বড় রান করার। তিনি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি।
সফল হননি রিঙ্কুও। স্পিনারদের নিয়ে আসার পর এমনিতেই কেকেআর ব্যাটারদের বড় শট খেলা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। জোরে বোলারেরা ঝুঁকেছিলেন স্লোয়ারের দিকে। ফার্গুসনের মতো বোলারও স্লোয়ার দিচ্ছিলেন। সে রকমই একটি বল শট খেলতে গিয়ে ফিরলেন রিঙ্কু। তাঁর জায়গায় নেমে আন্দ্রে রাসেলকেও বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তবে উল্টো দিকে থাকা শ্রেয়সের প্রশংসা করতেই হয়। পরিস্থিতি বুঝে তিনি খেলছিলেন। শট নির্বাচনে ছিল দক্ষতার ছাপ। জানতেন যে তিনি আউট হলে দল আরও চাপে পড়বে। তাই ঝুঁকি নিয়ে কোনও শট খেলতে যাননি। তাঁর সঙ্গে রাসেলের ৪২ রানের জুটি অনেকটা তফাত গড়ে দিল। ওই সময়ে আর একটা উইকেট পড়লেও চাপে পড়ত কেকেআর।
শ্রেয়সের আউট হওয়াটাও দুর্ভাগ্যজনক। নিশ্চিত চার যে ও ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুফে নেবেন ফ্যাফ ডুপ্লেসি, তা ভাবতে পারেনি শ্রেয়স নিজেও। মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে গেলেন। তার পরেও যে কেকেআর দুশোর গন্ডি পার করল, তার নেপথ্যে রয়েছেন রমনদীপ সিংহ। কেন তাঁকে খেলিয়ে মণীশ পাণ্ডেকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে এই প্রশ্ন অনেকেই তুলছিলেন। কিন্তু ১৯তম ওভারে সিরাজকে মারা দু’টি ছয় এবং একটি চারের কথা ভুললে চলবে না। ওই ওভারের ২০ রান কেকেআরকে অনেকটাই সাহায্য করল। শেষ ওভারে দয়ালও ১৬ রান দেওয়ায় দুশো পেরোতে অসুবিধা হয়নি।
আইপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২০৪ রান তাড়া করে জিতেছে আরসিবি। ফলে এই ম্যাচে নিজেদের ছাপিয়ে যেতে হত তাদের। প্রথম বলেই হর্ষিত রানাকে চার মেরে শুরুটা ভালই করেছিলেন কোহলি। প্রথম ওভারেই ১২ রান উঠে যায়। দ্বিতীয় ওভারে স্টার্ক দেন ১৫ রান। তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই তৈরি হয় বিতর্ক। হর্ষিতের স্লোয়ার বল কোহলির প্রায় কোমরের উচ্চতায় আসে। কোহলি কোনও মতে ব্যাট ঠেকানোর পর সেই বলে ক্যাচ নেন হর্ষিতই। কোহলি ‘নো বলের’ রিভিউ নিলেও দেখা যায় সেটি বৈধ। কারণ কোহলি ক্রিজ় থেকে এগিয়েছিলেন। রিপ্লেতেও দেখায় বল তাঁর কোমরের নীচেই রয়েছে। কোহলি অবশ্য খুশি হতে পারেননি। তিনি আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্ক করেন। ডাগআউটে ফিরেও প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত দেখায় তাঁকে।
কোহলি ফেরায় দায়িত্ব নিতে হত ডুপ্লেসিকে। কিন্তু তিনিও বেশি ক্ষণ টিকতে পারেননি। বরুণ চক্রবর্তীর প্রথম বলেই মিড অন দিয়ে খেলতে গিয়েছিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাল ক্যাচ নিয়ে ফিরিয়ে দেন বেঙ্কটেশ। বিপক্ষের দুই অস্ত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ায় স্বস্তি আসে কেকেআর শিবিরে। সেই স্বস্তি বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। উইল জ্যাকস এবং রজত পাটীদার কেকেআর বোলারদের বেশ চাপে ফেলে দেন। পাটীদার এত দিন ফর্মে ছিলেন না। জ্যাকস আগে ভাল খেলেননি। কিন্তু কেকেআরের বোলারেরা যেন দু’জনকেই ফর্মে ফেরানোর ‘পণ’ নিয়ে নেমেছিলেন।
কোনও বোলারকেই তোয়াক্কা করছিলেন না এই দুই ব্যাটার। স্পিন সহায়ক পিচে সূযশ শর্মাকে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসাবে নামানো হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় ওভারেই হল ২২ রান। অবলীলায় বল মাঠের বাইরে ফেললেন জ্যাকস। ছাড় পেলেন না নারাইনও। তাঁরও একটি ওভার থেকে এল ১৫ রান।
জুটি ভাঙলেন সেই রাসেল। এই পিচে তাঁর বোলিং সবচেয়ে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বলেই তিনি তুলে নেন জ্যাকসকে। ওভারের শেষ বলে আউট হন পাটীদার। বিপক্ষের সবচেয়ে বিপজ্জনক দুই ব্যাটারকে একই ওভারে তুলে নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ব্যাটার। পরের ওভারে জাদু দেখালেন আর এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান নারাইন। তিনি প্রথম বলে ফেরালেন ক্যামেরন গ্রিনকে (৬)। শেষ বলে ফেরালেন মহীপাল লোমরোরকে (৪)।
তখনও কেকেআর শান্তিতে থাকতে পারেনি। কারণ উল্টো দিকে কার্তিক ছিলেন। অতীতে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ৩৫ বলে ৮৩ রানের ইনিংস কেউই ভুলে যাননি। এ দিন তাঁর অর্ধেক খেললেই জেতা যেত। কিন্তু পিচ এবং কেকেআর বোলারদের বৈচিত্রের কারণে সহজে খেলতে পারেননি। রাসেলের ওভারে আউট না হলে অবশ্য কী হত বলা যায় না।